আমার নাকছাবিটা
“সুখ নেইকো মনে—
নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে ।”
সন্ধ্যেবেলা হলেই আমার মন প্রচন্ড
খারাপ হয়ে যায়। এত মন খারাপ সারাদিনে, সারারাতে কখনও হয় না। কেন তা জানি না। আমার পাশে
যেই থাকুক তাতে আমার কিছু আসে যায় না। মন খারাপ হবেই। আমি চুপ হয়ে যাব। সারা পৃথিবী
আস্তে আস্তে চুপ হয়ে যায়। পাখীদের কোন ডাক থাকে না। একটা মৃদুমন্দ বাতাস বয়। দূরে শঙ্খের
আওয়াজ আসতে থাকে ইতিউতি। একটা অজানা গন্ধ আমাকে চারিদিক থেকে যেন ঘিরে ধরে। আমার মন
খারাপ হয়ে যায়।
যেন আমার কিছু হারিয়ে গেছে। সেই ছোটবেলায়।
যা আমি খুঁজছি। কিন্তু পাচ্ছি না। কি হারিয়েছে? আমি জানি না। কিভাবে হারালাম? তাও জানি
না। কিন্তু যতটা সম্ভব আমি নিজেকে খুঁড়েছি, কিছু পাই নি। মন খারাপটা যেন আরও গভীরে।
তার কোনও তল নেই।
এই সময় চুপ করে বসে থাকি। এক ধরণের
কুড়েমি আমায় পেয়ে বসে। আমি যদি কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে সময় ভুলে না যাই তাহলে আমার মন
খারাপ হবেই হবে। আমি যত প্রকৃতির কাছে যাব তত মন খারাপের তীব্রতা বাড়বে। যারা আমাকে
জানে, তারা এই সময় আমাকে বিরক্ত করে না। চুপচাপ আমায় সঙ্গ দেয়, কিম্বা আমার হাত ছেড়ে
দূরে চলে যায়। অপেক্ষা করে। বা হারিয়ে যায় রাত্রির গভীরতায়। আমি তাদের খুঁজতে যাই না
আর।
চুপ করে আমি কি করি? আমি খুঁজি। কি
খুঁজি? জানি না। আমার কোন ধারণা নেই। অনেক ছোটবেলায় ঘাসের বনে খেলতে খেলতে আমি আমার
নাকছাবিটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এমনই এক সন্ধ্যেবেলায়। আমার চারদিকে আমার সাথীরা ঘিরে
দাঁড়িয়ে আছে। তারা বুঝতে পারছে না কি করবে। আমি ঘাসের বনে বনে খুঁজেই চলেছি, খুঁজেই
চলেছি। হলুদ ফুলের পাঁপড়ি ঝরিয়ে, সবুজ পাতা এলোমেলো করে। কিন্তু পাচ্ছি না।
মা বোঝালেন, আমাকে আবার একটা নাকছাবি
কিনে দেওয়া হবে। চড়কের মেলা থেকে কিনে দেওয়া হয়েছিল হারানো নাকছাবিটা। হারালে উদ্বিগ্নতার
কোন কারণ নেই। কিন্তু আমি আজও নাকছাবিটা খুঁজে যাচ্ছি। সেদিন কাউকেই বোঝাতে পারি নি
যে, আমি যাকে ভালবাসি, আমি যাকে বিয়ে করব বড় হয়ে, তার দেওয়া প্রণয়োপহার আমি হারিয়ে
ফেলেছি। সে মানুষটা আমার বাবা। আমার সব হারিয়ে গেল যেন এক লহমায়। আমার জীবনের একটা
বড়ো অংশ যেন নাকছাবিটার সাথে সাথে চলে গেছে। আমার শৈশবের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, হাসি-কান্না,
আনন্দ-বেদনা সেইক্ষণে আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমার বাবা আমাকে সোনার নাকছাবি দিয়েছে বড়
হয়ে। কিন্তু আমি আর সেই বাবাকে বিয়ে করতে চাই না। যে বিয়ে করতে চেয়েছিল, সে সেই ঘাসের
বনে এখনও নাকছাবিটা খুঁজে যাচ্ছে।
পিতা! তুমিও আমায় ত্যাগ করলে!
বাবাকে এখন আর চেনা যায় না। তার হাসিটা
অমলিন। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে মান আর হুঁশ আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। সে আর আগের মতো
কথা বলে না। আগের মতো আইসক্রীম কিনে দেয় না। লুকিয়ে টাকা দেয় না। আমার জন্যে মরণপণ
করে বর্ষারাত্রে ফিরে এসে আমার কোলে ফেলে দেয় না রবীন্দ্র রচনাবলী।
বদলে আমি বাবাকে ওষুধ মনে করিয়ে দিই।
আনমনে তার ছ্যাকা লেগে যাওয়া হাতে নরম করে মলম লাগিয়ে দিই। সুগার প্রেসার চড়চড় করে
বাড়লে তাকে তুমুল বকা দিই। ওষুধ শেষ হয়ে গেলে সাইকেল নিয়ে খুঁজতে বেরোই মহার্ঘ ওষুধের
পাতা। আমার পিতা এখন আমার পুত্র হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে গামছা হাতে বাথরুমে দৌড়াতে হয়।
ফুঁ দিয়ে গরম খাবার ঠান্ডা করে দিতে হয়। বদলে মেলে করুণ চোখের সজল চাহনী।
আমার নাকছাবিটা কেউ কি পেয়েছে? মনে
হয়, পেয়েছে। সন্ধ্যেবেলায় সে যেন আমায় ডাকে ক্লান্তস্বরে। ডেকেই চলে, ডেকেই চলে। আমার
ঘর পেরিয়ে, উঠোন পেরিয়ে, পাচিল ডিঙিয়ে, বাড়ী ঘর ছাদ টপকে, সময়ের অপর পাড়ের কোন এক ঘাসবনের
মধ্যে থেকে সে ডেকে চলে। আমার কোথাও যেন ফেরার আছে। আমি ফিরতে চাই...
===
লাইনদুটো আমি বাগিয়েছি বুদ্ধবাবুর কাছ থেকে, আর উনি ধার করেছেন
পুর্ণেন্দুবাবুর থেকে। এতএব, কাটাকুটি হয়ে গেল...
[ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত]
Comments
Post a Comment