ত্রিভঙ্গ

 


রেণুকা সাহানে এক জবরদস্থ বিষয় পাকড়েছেন। দিদা, মা, মেয়ে --- তিন প্রজন্মের সম্পর্কের টানাপোড়েন। এমন নয় যে এই বিষয়বস্তুটার মধ্যে নতুনত্ব আছে। আমরা তো ‘ঊনিশে এপ্রিল’ বা ‘তিতলি’ দেখেছি। কিম্বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বেশ কিছু উপন্যাস পড়েছি। সিনেমাটার মধ্যেও যে অপরূপ গভীরতা বা টানটান গল্প বলার ভঙ্গিমা আছে তা নয়। বরং পুরোটাই বেশ প্রেডিক্টেব্‌ল। সিনেমা শুরু হওয়ার আধঘন্টার মধ্যেই আমি জানি কি হতে চলেছে।

কিন্তু...

তনভী আজমী, কাজল এবং মিথিলা পালকরের অভিনয়সমৃদ্ধ এই সিনেমাটা আমাকে একটা বিষয় নিয়ে ভাবাল। সেটা বলি।

 

একজন শিল্পীর জীবন কেমন হয়? বিশেষত সে যদি জিনিয়াস হয়? আমরা জানি একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় সম্বল তার হৃদয়। ইংরাজীতে যাকে আমরা 'সেন্সিবিলিটি' বলি। সেটা থাকতেই হয়। তার ভক্তেরা কিম্বা একজন সাধারণ মানুষও যদি তার সামনে আসে, তাহলে যেটায় দুই পক্ষ সবচেয়ে বেশি অনুভব করে তা হল মানবিক আত্মীয়তা। এখানেই একজন অতি সাধারণ মানুষও শিল্পীর কাছে এলে একটা টান অনুভব করে, আপন বলে মনে করে। ফলে তার সৃষ্টি মানুষটার কাছে মনে হয় এ যেন তারই কথা বলছে। তাকেই অনুভব করে লিখেছে। এটাই তো শিল্পের গুণ। একটা সৃষ্টি যত বেশি সংখ্যক মানুষকে ছুঁতে পারবে, সেই সৃষ্টি ততই কালোত্তীর্ণতার পথ এগোবে।

কিন্তু এর একটা উলটো পিঠ আছে। রবীন্দ্রনাথের একটা কথা দিয়ে বললে বুঝতে সুবিধা হবে। ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইতে রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে বলছেন, “চিরদিন আমি একটা জায়গায় উদাসীন নিরাসক্ত ছিলুম। সেইটেই আমার স্বভাব। ভিতরে ভিতরে দূরে থাকবার একটা অভ্যাস ছিল সব কিছু থেকেই।” এই নিরাসক্ততার নঙর্থক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শিল্পীর সবচেয়ে কাছের মানুষজনের ওপর। তার বাবা-মা, কিম্বা ভাই-বোন, সবচেয়ে বেশি তার সঙ্গী এবং সন্তান। এবং এর প্রভাব অমোঘ। পড়বেই। যদি না অন্য পক্ষ বুঝতে পেরে ব্যাপারটাকে ট্যাকল করতে না পারে। সবসময়েই সমাজ এই শিল্পীদের বাঁকা চোখেই দেখে। শিল্পের রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শকে প্রাণের সমস্ত আকুতি দিয়ে চেখে চেখে অনুভব করার পর শিল্পীর দিকে তাকিয়ে তারা রোষদৃষ্টি হানে, কারণ শিল্পীমাত্রেই সমাজের প্রাত্যহিক জীবনে চুড়ান্ত অচল। আর অচল মানুষকে নিয়ে সমাজের কোন কাজ নেই। শিল্পীরা অনেক সময়েই এক নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধ জীবন কাটাতে বাধ্য হয়।

অপরদিকে পাশে যে মানুষটা আছে তারও বোধহয় কিছু করার নেই। সে জানে তার পাশের মানুষটা জিনিয়াস। তার সৃষ্টির জন্যে যে পরিমান পরিশ্রম আর একাগ্র সাধনার প্রয়োজন তাকে সেটা দিতে পারে তার এই পরিবার। কিম্বা অন্যান্য সময়ে তাকে বাচ্চাদের মতন লালন-পালন করতে হয়, সেই সময় শিল্পী তার এই কাছের মানুষ ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারে না। সেখানে সে অতি কাছের, পাশের, প্রাণের। কিন্তু যেই এই সবকিছু থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার সৃষ্টির কাজে ব্যাপৃত হয়, সে আবার অনেক দূরের মানুষ। ধরাছোয়ার বাইরে। তখন তার মতন নৃশংস মানুষ আর দুটি নেই বলে মনে হয়।

মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা প্রাণান্তকর। শিল্প যদি অর্থ সমাগমের পথ হয়, ছেলেদের ক্ষেত্রে তবুও বা পরিবার বেশ মেনেই নেয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বা গর্ববোধও করে। কিন্তু নারী হলে? আমাদের সমাজে অন্তত তা বড় বালাই। নারীর মাপকাঠি পরিবার। কতটা সময় সে পরিবারে দিতে পারছে। সমাজে সে এতকিছুর পরেও কতটা নিষ্কলঙ্ক। মেয়েলী কাজগুলো এত কিছুর পরেও কতটা নিপুণভাবে সে করতে পারছে। কিম্বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে সে কতটা Easy Available। মেয়েদের মাপকাঠি চিরদিনই এটাই হয়ে এসেছে। ফলে সমস্যা এবং অশান্তি অনেক বেশি। এর মধ্যে দিয়েও যারা উঠে আসেন জনসমক্ষে তারা আমার চোখে বিষ্ময়। তাদের সামনে আমি নত হই।

এই টানাপোড়েনটাকেই যখন আমাদের সামনে আনা হয় তখনই হতভম্ব হয়ে যাই। ‘ত্রিভঙ্গ’ সিনেমায় তিন প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে এই সমস্যাটা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। কারণ সমাজ তো আর বদলায় না, শিল্পীও বদলায় না। বদলে যায় কেবল দৃষ্টিভঙ্গীর তীব্রতা। আর তাই একসময়ে মেয়ের সমস্যার মধ্যে দিয়ে মা তার নিজের মা-কে বুঝতে পারে, সে দেখে সমস্যাটা একই, যা সে ফেস করেছিল, তাই-ই আবার ফিরে এসেছে তার মেয়ের কাছে। সেবার সে ভিকটিম ছিল, মা-কে তাই মনে হয়েছিল শত্রু; এবার সে শত্রু, কারণ একইভাবে সে ভিকটিম বানিয়েছে তার মেয়েকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে প্রতিবাদ না করে তার চয়েসকে গ্রহণ করেছে।

এখানেই সিনেমাটা অসাধারণ। তিনজনেই অভিনয় করেছেন দাপটে। তবে তনভী আজমীকে আমার বেশি ভাল লেগেছে। দুরন্ত সঙ্গ দিয়েছেন কানোয়ালজিৎ, মানভ গোহিল এবং অতি অবশ্যই কুণাল রয় কাপুর। এদের সবার মিলিত অভিনয়ে যে বিষয়টা অত্যন্ত সুন্দরভাবে উঠে আসে তা হল সম্পর্কের জটিল টানাপোড়েন। আমাকে ভাবায় এই টানাপোড়েন। পলিগ্যামি না মনোগ্যামি? যথেচ্ছাচার, না নীরব আত্মসমর্পণ? শিল্পসৃষ্টির তাগিদে, সমাজের মানুষদের তাগিদে নিজের সংসারের প্রতি উদাসীনতা, না কি সংসারের তাগিদে নিজের শিল্পসত্ত্বাকে বিসর্জন দেওয়া?

যেসব মানুষদের মধ্যে শিল্প আছে তারা চিরকালই এই যাঁতার মাঝখানে পিষে যাবে। তেল বের হবে, কিম্বা বের হবে না --- নির্ভর করবে তার প্রকাশের তাগিদের ওপর। কিছু মানুষ হয়তো পাশের মানুষটার কাছ থেকে সহায়তা পাবে, বাকিরা যাতার মাঝখান থেকে গলে পড়ে যাবে। জীবন তার নিজের হাতের এক ঝটকায় ছিটকে ফেলে দেবে তাদেরকে জন-অরণ্যের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া পথের এক প্রান্তে, অবহেলায়।

কতিপয় মানুষ হবেন রবীন্দ্রনাথ, পিকাসো, বেথোভেন, আকিরা কুরসোওয়া কিম্বা রদ্যাঁ। যারা দূর থেকে যাতাটা দেখে যাবে। দেখে যাবে কেমন করে পিষে যাচ্ছে মানুষ। কেমন করে বেরিয়ে আসছে বোবা আর্তনাদ। যদের কথা শোনার কেউ নেই। কেবল আছেন তারা। তারা সেইসব মানুষদেরকে সৃষ্টি করবেন নিজের সৃষ্টিশীলতার মধ্যে দিয়ে। তাদের অমর করবেন। নিজেরাও অমর হবেন...

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে