এবং হুমায়ুন

 



আমার জীবনে হতে গোনা কয়েকজন লেখক আছেন, যাদেরকে এড়িয়ে যেতে চাই। তার মধ্যে হুমায়ুন আহমেদ একজন। হুমায়ুন আহমেদকে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ চিনেছে অনেক দেরীতে। শুনেছি সুনীলের উদ্যোগে তার উপন্যাস টানা দশ বছর ধরে দেশের শারদীয়ায় বেরিয়েছিল। কিন্তু এপার বাংলায় তেমন সমাদর পায় নি। PDF এর রমরমা শুরু না হলে এখনও কয়জন চিনত সন্দেহ আছে। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবৎ হুমায়ুন আহমেদের চাহিদা তুঙ্গে। শুনেছি তার হিমু আর মিশির আলী সমগ্র, গল্প সমগ্র কলেজ স্ট্রীটের অলিতে গলিতে পাওয়া যায়।

আমি একটা সময় হুমায়ুন আহমেদ পড়তে শুরু করি। অবস্থা এত খারাপের দিকে গিয়ে দাঁড়ায় যে একসময় আমার কাজই ছিল রোজ রাত্রে খেয়ে উঠে একটা উপন্যাস শেষ করে তবে ঘুমাতে যাওয়া। মাস দেড়েক পর যখন ক্ষান্ত দিলাম, বুঝতে পারলাম হুমায়ুনের একটা কিছু স্বত্ত্বা বা স্টাইল আমার মধ্যে ঢুকে কোথাও অবচেতনে গেড়ে বসে গেছে।

সেদিন থেকে আমি জানি, আমি লিখতে পারব। তার আগে লেখা তো দূর, লেখার কথা ভাববারও সাহস দেখাইনি। ছোট ছোট উপন্যাস। ছোট ছোট বাক্য। অত্যন্ত সরল বাক্য কিন্তু বিন্যাস কি মায়াময়! লেখার পাঞ্চলাইনে কীভাবে চিরন্তনী অনুভূতিগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তা হুমায়ুন আহমেদ শিখিয়েছেন। তার মতো করে লিখতে এই সময়ে কয়জন পেরেছেন? আমার তো একটা নামও মনে পড়ছে না।

এহেন মানুষটার চলে যাওয়া আমাকে বড্ড কষ্ট দিয়েছিল। হতাশা গ্রাস করেছিল। আর তারপর তার লেখা পড়াই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভয়ঙ্কর ক্ষমতা এই লোকটার। মাথার ভেতরে ঢুকে যায়। ভোলা যায় না উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে। এমন মানুষের লেখা এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কি?

আমার ফেসবুকতুতো ভাই D Chakrabarty অনেকদিন পর আমার সর্বনাশ করল। একটা উপন্যাস পাঠিয়ে দিয়ে নিরীহ প্রশ্ন করল, এটা কি তুমি পড়েছ দিদি?

আমি বললাম, না। সে বলল, তোমাকে পাঠাচ্ছি। সময় করে পোড়ো। বুঝলাম, আবার একটা রাত জাগতে হবে।

কাল সারারাত জেগে উপন্যাসটা শেষ করলাম। একটানা। মাঝরাতে শেষ হল। চরিত্রগুলোকে মাথায় নিয়ে শুতে গেলাম। তারপরেও ভোর হয়ে গেল। ঘুম এল না। উপন্যাসের মূল ঘটনা একটি অপরিচিত ছেলে, যে কি না ম্যাজিশিয়ান, যে নিজেকে গাছ বলে, তার একটি পরিবারের সাথে জুড়ে যাওয়া। এবং তাকে ঘিরে বেশ রহস্যের পরিবেশ তৈরী হয়। পরিবারের স্নেহে-ভালোবাসায় একটা সেতু তৈরী হয় পরিচিতে-অপরিচিতে। মানুষ তো এইভাবেই মানুষের কাছে আসে। তাই না? মানবতাবাদের প্রশ্নে হুমায়ুন অদ্বিতীয়। ফলে আমার কাছে এটা আর কল্পবিজ্ঞান থাকে না। হয়ে ওঠে একটা মায়াময় উপন্যাস।

যতদূর জানি, এই বইটা হুমায়ুনের কল্পবিজ্ঞান সমগ্রতে স্থান পায় নি। ভালই হয়েছে। এ গল্প কল্পবিজ্ঞানের নয়। কল্পমানবিকতার। আর তাই চরিত্রগুলো কখন আস্তে আস্তে মনের গভীরে ঢুকে যায় ছোট ছোট বাক্যের অন্তরালে, বোঝাই যায় না।

এই উপন্যাসটা হুমায়ুনের বহুল চর্চিত গাছপ্রীতির একটা বড় নিদর্শন। গাছের ওপর একটা প্রচন্ড ভালবাসা আছে তার। অনেক উপন্যাসে সেটা তীব্রভাবে বর্তমান। থাকাই উচিৎ। যিনি জ্যোৎস্না দেখতে ভালবাসেন, যিনি মানুষ ভালবাসেন, তার কাছে গোটা প্রকৃতিটাই তো আপন। ফলে এ বিশ্ব যে কারণে টিকে আছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা এবং ভালবাসা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এবং তার এই ভালোবাসা কোথাও আমাদের মধ্যেও ঢুকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। তার পূর্ণ প্রয়োগ তিনি করেছেন।

হুমায়ুন সাহেব, আপনি বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আরেকটু কি অপেক্ষা করা যেত না? আর আপনার রচনাবলীর অনেক দাম। রবীন্দ্র রচনাবলীর মতো আপনার রচনাবলীর কেন সুলভ সংস্করণ বেরোবে না? আমাদের যে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার অভ্যাস। একটা নয়া পয়সা পাওয়ারও কি স্বপ্ন সত্যি হবে না?

 



Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে