নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড


 

‘স্ববিরোধী চিন্তা’

এই শব্দজোড়া আমায় তাড়া করে বেড়ায়। যেখানেই যাই, যা-ই ভাবি, কিম্বা যা কিছুই পড়ি না কেন এই শব্দদুটো আমায় মাঝে মাঝেই চমকে দিয়ে যায়। কখনও মনে হয়, শব্দজোড়া ‘হিপোক্রিট’ হওয়ার আঁতুড়ঘর, আবার কখনও মনে হয় ‘আনবায়াসড’ চিন্তাভাবনা করার অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। কেমন ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যাক।

সোশাল নেটওয়ার্ক একটা খোলা পাতার মতো। সেখানে যে কাউকে যা খুশি বলার অধিকার আছে। আমরা একে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলছি। এখানে আমরা এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি যে, দেখেছি, একটা পোস্টের প্রেক্ষিতে পোস্টদাতাকে হয়তো ‘দেশদ্রোহী’ থেকে শুরু করে ‘দালাল’ তকমা দেওয়া হল। তাকে লাইফ থ্রেট দেওয়া হল। অত্যন্ত অশালীন ভাষায় অপমান করা হল। এবার যে বা যারা এমন করল তাদের টাইম লাইনে একটু ঘুরে আসুন। দেখবেন, তাদের কেউ কেউ হয়তো তার পরম প্রিয় জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীর সাথে রেস্তোঁরাতে জন্মদিন পালন উৎসবের ছবি দিয়েছে; অথবা পরের পোস্টে অত্যন্ত শালীন সুন্দর ভাষায় তার নিজের চিন্তাধারাকে ব্যক্ত করছে। সব মিলিয়ে ‘ফিল গুড’ দেওয়াল। অর্থাৎ, দুটো ক্ষেত্রে একটি অপরটিকে কনট্রাডিক্ট করছে। অথচ ব্যাক্তি একই।

এবার রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ নেওয়া যাক। যে মানুষটা জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করছেন (মনে রাখতে হবে, এই সময়ে মহাত্মা গান্ধী ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে এগোচ্ছিলেন), সারা দেশ যার স্বদেশপ্রীতির কারণে তাকে অভিনন্দিত করে ভাসিয়ে দিচ্ছে (এখনও দেয়), সেই মানুষই উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যখন ‘ঘরে বাইরে’ লিখে গোটা দেশকে সাবধান করে দিচ্ছেন, তখন মহাত্মা গান্ধী সমেত গোটা দেশের মানুষের বিরক্তি কুড়াচ্ছেন। কিন্তু আজ যখন সেই উপন্যাসটা আমরা পড়ি এবং পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পড়ি, বুঝতে পারি যে মানুষটা কতটা দূরদর্শী ছিলেন!

এই যে স্ববিরোধী ভাব --- এই ভাব একটা ক্ষেত্রে দুর্বল মানুষকে ধ্বংশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আবার আরেকটা ক্ষেত্রে সবল মানুষ অবাক বিস্ময়ে বলে ফেলেন --- তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি / বিচিত্র ছলনাজালে, / হে ছলনাময়ী।

দস্তয়েভস্কি এই দুই ধারার উপর দিয়ে গেলেন। দুটো ক্ষেত্রকেই একটা প্ল্যাটফর্মে নিয়ে চলে এলেন। একটাই শব্দ এখানে --- স্ববিরোধীতা। নিকোলাই চেব্‌নিশেভস্কি’র একটি উপন্যাসের পালটা উপন্যাস লিখতে গিয়ে যে উপন্যাস জন্ম নিল তা বোধহয় অনেক অনেক বছর পর্যন্ত মানবজাতিকে আচ্ছন্ন করে রাখবে, তর্ক-বিতর্কের মধ্যে ফেলে রাখবে। উপন্যাসটি শুধু মৌলিকই হল না। জন্ম দিল ‘এক্সিটেনশিয়ালিজম্‌’–এর। যা নিয়ে পরের যুগে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে। সার্ত্রে, কাম্যুর হাত ধরে মার্কেজ, মুরাকামি হয়ে বাংলায় সমরেশ-শীর্ষেন্দু পর্যন্ত একটা লাইন আপ তৈরী হবে। তবু এর জনক অতলে হারাবেন না। এতগুলো সূর্যের মাঝেও নিজ দীপ্তিতে অম্লান হয়ে থাকবেন।

দস্তয়েভস্কি বললেন, মানুষ অনেক সময়ে তার স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করতে গিয়ে নিজের স্বার্থবিরোধী কাজও করে বসে। কেমন? আমরা কি দেখি না, অন্যের ক্ষতি করতে গিয়ে মানূষ নিজের ক্ষতি করে! বা এই উপন্যাসের নায়ক তার প্রথম পর্ব জুড়ে যে স্ববিরোধী চিন্তা করেছেন তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটে সরাইখানায় বন্ধুদের রিইউনিয়ানে। আর তার সেই চিন্তাধারাই দফায় দফায় পর্যুদস্ত হয় লিজার সামনে, আপোলনের সামনে। কারণ, নায়ক এখানে এক দুর্বল চরিত্রের মানুষ।

আমরা কি আমাদের নিজেদের অন্ধকার অংশের দিকে নজর দিয়েছি? খুব কম। আমরা রাগ করি। কারোর বিরুদ্ধে মনে মনে বিষোদ্‌গার করি। নিজেকে নায়ক বা নায়িকার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে কত কাজই না করি। সব কিন্তু কল্পনায়। আর এই কল্পনাই আমাদেরকে আমাদের থেকে দূরে নিয়ে যায় শুধু নয়, আমাদেরকে নিস্তেজ করে। আমাদের মেরুদন্ড, আমাদের নীতি, আমাদের চিন্তাধারাকে দুর্বলতার দিকে ঠেলে দেয়। আমি নিজেই তখন নিজের শত্রু। অর্থাৎ, আমার স্বাধীন ইচ্ছাই আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। এবং আমি এখন আমার আশেপাশের মানুষদেরও শত্রু।

তাহলে উপায়? ভালোবাসাই একমাত্র এই সমস্যাকে সরাসরি দেখার ক্ষমতা রাখে। যে ভালবাসে সে অপরের এই সমস্যাটা সরাসরি দেখতে পায়। আর যখন দেখতে পায়, তখন সে শুধুমাত্র যদি নীরবে মুখোমুখি হয়ে থাকে তবে তার চোখের দিকে তাকালেই যার সমস্যা সেও নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে। তার সন্মানবোধ তখন বড় বাধা। সে নত হবে ভালবাসার সামনে, না কি ঔদ্ধত্য দিয়ে শাসন করবে এই ভালবাসাকে? যাই হোক না কেন, দস্তয়েভস্কি’র মতে, স্বভাব তবুও ছেড়ে যাবে না। আর আমাদের স্বভাবই হল স্বাধীন ইচ্ছার অপপ্রয়োগ, বারে বারে, কোন কারণ ব্যতিরেকে।

এই বইয়ের মুখোমুখি হওয়া খুব কঠিন। কারণ আমাদের গোপন ভাবনাচিন্তার মুখোমুখি হওয়া খুব খুব কঠিন। এই উপন্যাসটা আমি এই নিয়ে বেশ কয়েকবার পড়লাম। প্রতিবারই পড়তে পড়তে কি মনে হচ্ছিল জানেন? মনে হচ্ছিল আমি এমন একটা ঘরে চলাফেরা করছি, যে ঘরে অনেক আয়না। যেখানে সেখানে। ছোট বড়ো। সেই আয়নায় মাঝে মাঝে আমাকে দেখা যাচ্ছে। কখনও কখনও আমি নিজেকে যেন দেখেও দেখছি না। এড়িয়ে যাচ্ছি। তা স্বত্ত্বেও কোন না কোন আয়নায় নিজেকে তো চোখে পড়বেই। আর সেই আয়নায় আমি নিজেকে দেখছি একদম উলঙ্গ, নগ্ন। সেই প্রতিবিম্বের কোন জামা-কাপড় নেই। তার শরীরে কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। আছে একটা স্বত্বা। ভেতরের মানুষ। সেই মানুষটাও আমাকে দেখছে। স্থির চোখে। আমার চোখে চোখ রেখে...

আমি অনুবাদ পড়েছি মোট চারটে। প্রথমটা রোনাল্ড উইল্কসের। পেঙ্গুইন থেকে এই বইটা বেরিয়েছে। পড়ে মনে হয়েছিল যেন কিছুই বুঝলাম না ঠিক। তারপরে হাতে এল খন্দকার মজহারুল করিমের অনুবাদ – অজ্ঞাতবাসের পত্র। পড়তে পড়তেই মনে হচ্ছিল, বুঝছি বটে, তবে ঠিক ব্যাটে-বলে হচ্ছে না। পাশাপাশি পড়তে শুরু করলাম কন্সট্যান্স গার্নেটের অনুবাদ। কঠিন অনুবাদ (আমার কাছে)। তবুও পাশাপাশি রেখে পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল দস্তয়েভস্কি সামনে এসে যেন মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছেন। আমার চুলে হঠাৎ হঠাৎ টান লাগছে, আমি চমকে উঠছি। বিশ্বাস করা কঠিন যে এমন একটা উপন্যাস লেখা সম্ভব। অপেক্ষা করতে লাগলাম অরুণ সোম যদি অসাধ্য সাধন করেন। করলেন না। করলেন দেবাশিষ হালদার। অরুণ সোমেরই সহায়তায়। এই অনুবাদটা সত্যিই অপূর্ব হয়েছে। একদম মনের মতো। পড়তে পড়তে ভুলেই গিয়েছিলাম যে এটা অনুবাদ। দেবাশিষ বাবু’র বারো বছরের পরিশ্রম সত্যিই সফল।

 

=====

 

নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড

লেখকঃ ফিওদর দস্তয়েভস্কি

অনুবাদকঃ দেবাশিষ হালদার

প্রতিক্ষণ পাবলিকেশান

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০ টাকা

 


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে