ওরা আমাকে...

 



“ওরা আমাকে মোটামুটি তিনবেলা খেতে দিত। অন্য মেয়েরা তাও পেত না। তারা দুবেলা কি একবেলা আধপেটা খেতে পেত। ওরা জমিতে মুনিষের কাজ করত, তারপর ঘরের কাজ আর রাত্রে...”

“আর তোমাকে?”

“আমার সাথে ভাল ব্যবহার করত। আমি বয়সে ছোট, ফর্সা গোলগাল চেহারা, সুন্দর দেখতে, স্বাস্থ্য বেশ ভাল বলে আমাকে খুব যত্ন আত্তি করত। কিন্তু...”

“কিন্তু কি?”

“তার একটা কারণ ছিল। আমায় ওরা এক কাপড়ে রাখত।”

“মানে?”

“মানে শাড়ী ছাড়া আর কিচ্ছু পড়তে দিত না। কাপড় তাও হাটুর ওপর তুলে পরতে হত। বাড়ীর সবাই যখন খুশি, যেভাবে খুশি আমার সাথে... এমনকি আত্মীয় স্বজন এলে তাদের ঘরেও আমাকে পাঠাত ওরা।”

“সে কী!”

“হ্যাঁ জানোয়ার ওরা সবাই। ভালবেসে পালিয়ে বিয়ে করলাম, তারপর এখানে এসে দেখলাম আমার স্বামীর কাজই এটা। সারা ভারত ঘুরে ঘুরে মেয়ে জোগাড় করা। ওদের গোটা পাড়াটাই এরকম।”

“তুমি কিছু বলোনি কাউকে?”

“কাকে বলব? ওদের ভাষাই তো বুঝি না। শাশুড়ী প্রথম রাতে আমাকে ভাল করে সাজিয়ে গুজিয়ে শ্বশুরের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল।”

“মেয়েরাও এই কাজে সাহায্য করে!”

“না করে যাবে কোথায়? মেরে শেষ করে দেবে না। শাশুড়ীকে কতদিন মার খেতে দেখেছি। ও বাড়ীর সবাই, দেওর, বোনের বর, এমনকি বোনটাও...”

“বোনটাও...! তোমাকে!!!”

“হ্যাঁ, বাড়ীর কাউকে না জানাতে শাষিয়েছিল। না হলে ওকে মেরে ফেলত এটা করার জন্য। এটা পাপ, কিন্তু বোনটার খুব ভাল লাগত।”

“পুলিশে যেতে পারতে, বা পঞ্চায়েতে”

“ওখানে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে গ্রামের কয়েকজন মোড়ল এসেছিল। এক-এক রাত্রে আমাকে সেজেগুজে ওদের কাছেও যেতে হয়েছিল। বেশ কয়েকদিন পুলিশের লোকও এসেছিল। বাড়ীর লোকেরা আমাকে বউ সাজিয়ে একদিন থানায় পাঠিয়ে দিয়েছিল ওদের কথামতো। ওখানে সেদিন সারারাত অনেকে মিলে একটা সেলের মধ্যে ঢুকিয়ে...”

“...”

“ওদের গ্রামটাই ওরকম। আরোও আশেপাশের গ্রাম আছে। ওখানে মেয়ের সংখ্যা অনেক কম। আমি নিজের চোখে দেখেছি, অনেক বাড়ীতে মেয়ে হলে গামলার জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলে, তারপর মাটিতে পুতে দেয়। কেউ টের পায় না। পালানোর পথ নেই ওখান থেকে। আপনারা কীভাবে খবর পেলেন? পাঁচ না সাত কত বছর হয়ে গেল আমি জানি না। আমার পেটের ছেলেদুটো কার, আমার বরের, না শ্বশুরের, না দেওরের, না অন্য কারো আমি জানি না...”

=============

গ্রামটার নাম বললাম না, মনে নেই। এ গ্রামটা হরিয়ানা, কিম্বা হিমাচল প্রদেশ, কিম্বা উত্তরপ্রদেশ, কিম্বা বিহার, বা মধ্যপ্রদেশ। এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। ঘটে চলেছে। শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। শিক্ষার আলো কম পড়ার ফল। শিশু নারীহত্যার ঘটনা এতই স্বাভাবিক যে আমাদের বাংলাতেও দেখতে পাই প্যাথলজি ল্যাবে লেখা থাকে “এখানে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় না”। এ নিয়ে বহু মানুষ লিখেছে, সিনেমা হয়েছে, NGO রা দারুন কাজ করছে । কিন্তু তবুও মানুষ কতটা উদার হয়েছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

কেন লিখলাম এটা? সম্প্রতি একটা বই হাতে এসেছে, গোগ্রাসে গিলছি --- গান্ধী উত্তর ভারতবর্ষ। সেই বইয়ের ‘অধিকারসমূহ’ অধ্যায়ের এক্কেবারে শেষ পর্বে মাত্র দুই পাতায় এই বিষয়টা নিয়ে লেখা হয়েছে। রামচন্দ্র গুহ অত্যন্ত সফিস্টিকেটেড মানুষ। তার লেখায় থাকে বুদ্ধিদীপ্ততার প্রলেপ। কিন্তু বাস্তবটার ইঙ্গিত থাকলেও কঠিন বাস্তবটা লেখেননি উনি। বাস্তবটা খানিকটা এরকম। ওনার লেখাটা পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল এরকম একটা বাঙালী মেয়ের স্বীকারোক্তি। কোন ডকুমেন্টারি মনে নেই। মেয়েটার মুখ ঝাপসা ছিল। কিন্তু কথাগুলো এখনো কানে বাজে...

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে