ছেলেরা কাঁদে না

 



আমার হতভাগা আমাকে হঠাৎ ফোন করল, তুমি কি বাড়িতে একা?

আমি ফাজলামি করে বললাম, হ্যাঁ। তুমি কি আসবে? মা-বাবার আসতে এখনো ঘন্টা দুই লাগবে...

“বাজে কথা বোলো না, আই এম সিরিয়াস।”

“কি হয়েছে?”, আমি ওর গলা শুনে একটু থতমত খাই।

“আমি তোমার বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। **** আমার সাথে আছে। ওকে একটু সামলাও...”

 

আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। যাকে ও সাথে নিয়ে এসেছে তার নাম সানী। সানী আমার মেয়েবেলার বন্ধু। সানী নামটা আমার দেওয়া। একটা বিশেষ কারণে কিশোরীবেলায় নামটা দিয়েছিলাম। সারা পৃথিবীর লোক ওকে এক নামে ডাকে, আর আমি ওকে নিজেদের মধ্যে থাকলে ‘সানী’ নামে ডাকি। আমরা একসাথে বড় হয়েছি। আমার মা-বাবা ওকে খুব পছন্দ করে। স্কুল-কলেজ লাইফে অনেকদিন আমার বাড়ী এসে বাড়ীর সবার সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে গেছে সারাদিন। পরীক্ষার আগে আমরা একসাথে রাত জেগে পড়াশোনাও করেছি। অনেকদিন সে আমার চুল বেধে দিয়েছে। এমনকি আমাকে খাইয়েও দিয়েছে। আমাকে অনেক ছেলের হাত থেকেও সামলেছে। ও আমার ফ্যাশন ডিজাইনার, মেক-আপ ম্যান। মোট কথা ও আমায় একটা সুন্দর মেয়েলী বোধ দিয়েছে। আজ আমি যেভাবে নিজেকে ক্যারি করি তাতে ওর অবদান কোথাও কোথাও আমার মায়ের চেয়েও বেশি। কখনো কখনো তো আমার হতভাগার সাথে বেড়াতে বেরোনোর কথা থাকলে আমাকে পৌছেও দিয়েছে নিভৃতনিকুঞ্জে। আমার হতভাগাও ওকে বেশ পছন্দ করে। এমন একটা ছেলের হঠাৎ কি হল?

কলিং বেল বাজল। দরজা খুললাম। সানী দাঁড়িয়ে। চোখ-মুখের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। ও কোন কথা না বলে ভিতরে আমার ঘরে চলে গেল। আমি দেখলাম আমার হতভাগা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, স্থির চোখে সানীকে দেখছে। ও ভেতরে চলে যেতেই আমাকে সানীর দিকে ইঙ্গিত করে বাইক নিয়ে চলে গেল। সঙ্গে ওর কিছু বন্ধু। ইঙ্গিতটা কিছুই বুঝলাম না।

আমি দরজা বন্ধ করলাম। আর আমার ঘরের দরজার সামনে এসেই থমকে গেলাম। সানী কাঁদছে। বিছানার একধারে বসে দুহাত দুদিকে রেখে দেহটাকে কোনক্রমে ভর দিয়ে মাথা নীচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার দেহ কান্নার দমকে চমকে চমকে উঠছে।

আমি কাছে গিয়ে দাড়াতেই সানী লাল চোখে আমার দিকে তাকাল। তারপর অতর্কিতে যা করল তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মুখ গুজে আর্তনাদের মত কেঁদে উঠল। আমি কোনরকমে তাকে জড়িয়ে ধরে অদ্ভুত আতঙ্কে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

একটা ছেলে কাঁদে কেমনভাবে? আমি জানি না। আমার ভাইকে কাঁদতে দেখি নি কোনদিন। আমার মা-বাবা পিটালে গোঁজ হয়ে থাকত। কিন্তু কাঁদত না। বাবাকে নীরবে চোখ ছলছল করতে দেখেছি। ব্যাস ওইটুকুই। আমরা মেয়েরা যেভাবে ফ্যাঁচফ্যাঁচ, ফোঁসফোঁস বা হাউমাউ করে কাঁদি ছেলেরা তো কই তেমন কাঁদে না! সানী কাঁদছে। এমন মর্মান্তিক কান্না আমি কোনদিন কাউকে কাঁদতে দেখিনি। এ কান্নায় তেমন চীৎকার নেই, কিন্তু হাহাকার আছে। পৃথিবী হারানো হাহাকার। এ কান্না এক বিশাল শূন্যতার কান্না। বিপুল এক বিষন্নতা অপরিমেয় অতলান্তিক তীব্র যন্ত্রনায় হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এক বোবা মুক রাস্তার কুকুর যেন একের পর এক কশাঘাত সহ্য করতে করতে অসহায়ভাবে গোঙ্গাচ্ছে। এ কেমন কান্না! এই ছেলেটার মধ্যে এত যন্ত্রনা জমেছিল কবে থেকে! আমরা তো কেউ টের পাইনি! যেন কতকালের অভাব অভিযোগ ফোঁপানি হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওর মুখ থেকে লালা বেরিয়ে আসছে। চোখ থেকে জল পড়েই যাচ্ছে। আমার জামা ভিজে যাচ্ছে। ওর হেঁচকি উঠছে। তবু থামতে চাইছে না। যেন কাঁদতে কাঁদতেই নিঃশেষ হয়ে যেতে চাইছে।

আমি চুপ করে রইলাম। ওকে শান্ত হতে অনেকটা সময় দিতে হবে। আমার কাছে কান্নার স্রোত বইয়ে দিয়ে কোনো একটা ভার যেন কমাতে চাইছে ও। এই কান্না যদি না বেরিয়ে আসে তবে বাকি জীবন ওকে এই গুরুভার বয়ে যেতে হবে। আমি কেবল শক্ত করে সানীকে জড়িয়ে ধরে রইলাম। আমার চশমা কখন ঝাপসা হয়ে গেছে আমি নিজেই জানি না...

 

সানী আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। আমার হতভাগা আর তার বন্ধুরা ওকে রেললাইনের ধারে আবিস্কার করে। টেনে হিঁচড়ে বাইকে তুলে কোথায় যাবে বুঝতে না পেরে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। এই প্রথম জানলাম, সানী সমপ্রেমী। এবং একজনের সাথে তার সম্পর্ক ছিল প্রায় পনের বছর ধরে! আমাদের গ্রামীণ মফস্বলে এই সম্পর্ক তো পরচর্চার বিষয়। সবাই যদি জানত ও কে তাহলে ‘লেডিস’, ‘হিজড়া’, ‘জিগোলো’ বলে খেপিয়ে খেপিয়েই হয়তো ঝাঝরা করে দিত। তাই ও কাউকে বলে নি। আমাকেও না। যার সাথে ওর সম্পর্ক সে-ও খুব ভাল মানুষ। সানীকে সে ঠকায়নি। কিন্তু সম্পর্কটাও আর টেকে নি।

বিশ্বাস করুন সানীকে দেখে কেউ বলবে না যে ও ‘গে’। সানীর মধ্যে কোন মেয়েলী আচরণ নেই। সানী কোনদিন বলেনি ও মেয়েদের জামা-কাপড় পড়তে পছন্দ করে। ও মৃদুভাষী, মেয়েদের অসম্ভব ভাল বোঝে, আর একটু নরম মনের --- ব্যাস! এর বেশি কিছুই নয়। ওর একটা স্পষ্ট মতামত আছে। উচিৎ কথা বলতেও ডরায় না। না বললে বাইরে থেকে কীভাবে বুঝব ও একটা ‘গে’ এবং ‘বটম’!

সানীর সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেছে। সানীই শেষ করে এল। সবটা শুনলাম। দোষ-গুণের বাইরে কেউই নয়। যতটুকু বুঝলাম, এ প্রেম অসম্পূর্ণ। একে টেকানো যাবে না। সানীও বুঝতে পেরেছিল তিন বছর ধরে। কেউ কারো সাথে বেইমানী করে নি। কিন্তু মানসিক দূরত্ব বেড়েই যাচ্ছিল অল্প অল্প করে। দুজনের সেপারেশান ছিল সময়ের অপেক্ষা।

এরকম প্রেম ভেঙ্গে যাওয়া অসমপ্রেমীদের ক্ষেত্রে এখন মুড়ি মুড়কি। MOVE ON শব্দটা সম্পর্কের পিছনে পিছনে গাধাবোটের মত চলে ফিরে বেড়ায়। কিন্তু সমপ্রেমের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা মনে হয় মারাত্মক। এক তো লুকিয়ে প্রেম; দুই, এর কোন ভবিষ্যৎ নেই (শহরে চালচিত্র অন্যরকম হলেও গ্রামে বা মফস্বলে আমরা এখনো অতটা সড়গড় হই নি); আর তিন, একবার সম্পর্ক ভেঙে গেলে আবার নতুন করে তৈরী করা খুবই কঠিন।

আমি সানীকে নতুন করে দেখছি। এতদিন ধরে চিনি কিন্তু কিছুই চিনি না। সানীকে খুব মিস্টি দেখতে। একবার দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সুন্দর ওর আচার-আচরণ। খুব সাজানো গোছানো। কতবার আমার ঘর গুছিয়ে দিয়েছে সুন্দর করে। ওর মধ্যে একটা সৌন্দর্যবোধ আছে। সমকামীরা এত ভালো হয়! সানীর সঙ্গে থাকলে আমার নিজেকে খুব নিরাপদ লাগে। সানী মন খারাপের দিনগুলোতে আমাকে সঙ্গ দেয়। আমার কোন মেয়েবন্ধু এতটা নির্ভরশীল নয়, যতটা সানী। আমার হতভাগাও আমাকে এতটা সুন্দরভাবে সামলাতে পারে না যতটা সানী পারে। সানী, তোর মত সমকামী বন্ধু আমার আরোও কেন হল না? বন্ধুত্বের মর্ম তো তুই আমাকে শিখিয়েছিস। কী করলে তোর এই যন্ত্রণা আমি নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিতে পারব সেটা আমায় বল। আমি তোর জন্য সব করতে পারি। স-অ-ব...

 

---

 

বিঃ দ্রঃ – ১। সানী যে সমকামী এটা আমার ভাই, আমার হতভাগা অনেকদিন আগে থেকেই ধারণা করেছিল। কেবল আমিই আন্দাজ করতে পারি নি। ভাই বলল, তুই একটা মাথামোটা। হতভাগাটা বলল, তুমি একটা রামকেবলী।

 

২। সানী লেখাটা পড়ে মিস্টি হেসে আমার গালে চকাস করে একটা চুমু খেল। বলল, তোর লেখায় আমার আসল নামটা দিস না। যে নামে তুই আমায় ডাকিস সেই নামটাই রাখ...

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে