যেতে নাহি চাই

 



বসন্তোৎসবের বিকেল। আমি আর আমার হতভাগা বেরিয়েছিলাম সেজেগুজে। শাল-পলাশ আর আমবাগানের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলার পথ। এ পথে আমরা হেটেছি বহুবার। অনেক মান-অভিমানের সাক্ষী এই পথ। কলেজের দিনগুলো থেকেই এ পথের ধূলিকণা আমাদের পায়ে পায়ে। বসন্তের দক্ষিণ সমীরণ, আমের বোলের ম ম করা গন্ধ, পলাশের রক্তিম ছটা আর ভ্রমরের গুঞ্জন আমাদের ঘিরে ঘিরে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কনে দেখা আলোর মন কেমন করা সমুদ্রের মধ্যে ভেসে যেতে যেতে মন এমনিতেই স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতি যখন কথা বলতে শুরু করে তখন তার নিঃশব্দ শব্দচেতনায় হৃদয় ভাসিয়ে দিতে মন চায়। আমরা নীরবে হাটছিলাম।

কিন্তু কি বলে প্রকৃতি? সবুজ হয়ে সেজে ওঠা অরণ্যসভায় কি শুধুই নতুনের আবাহন? না। ঝরাপাতার মরসুম যে শেষ হয়েছে সদ্য তার চিহ্নও তো সবুজ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে। অথচ তা আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। বিরহের সুর আনন্দের উত্তেজনায় ঢাকা পড়ে যায়। সে মাথা নীচু করে আমার পাশে পাশে হাটে। শাড়ীর আঁচলে বারবার টান দিয়ে দিয়ে বলে, আমার কিছু কথা আছে। শুনবে?

আমার চোখ চলে যায় আমার পায়ের কাছে, পথের দুধারে মন কেমন করা সবুজের ফাঁকে ফাঁকে নীল, সাদা, বেগুনি ফুল। চোখ জুড়ানো সাজে এমন বসন্ত কি আগে দেখিনি? কি জানি। আমার শাড়ীর আঁচল তার ওপর দিয়ে আলতো করে বয়ে যাচ্ছে। ঘাসের পাতায় কোন চাঞ্চল্য নেই। কেবল ঘাসের ফুলে ফুলে সাড়া পড়ে গেছে। তারা মাথা হেলিয়ে ঢলে ঢলে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায়।

যা কোনদিনও করি নি, এই প্রথমবার তাই করলাম। আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে থাকা হাত আলগা হয়ে বিচ্ছিন্ন হল। পায়ের হিল তোলা জুতো খুলে ফেলে ঘাসের কার্পেটে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গেলাম একটু। দাঁড়ালাম অরণ্যের মাঝে। আমার সাথী দূরে, বহুদূরে, পথের মাঝে ফোনে ব্যাস্ত। তার সাবধানী চোখ আমার দিকে। আমি নিশ্চিন্তে এগিয়ে গেলাম আরেকটু গভীরে।

সেখানে কোন কৃত্রিমতা নেই। আছে পাখীর আওয়াজ, শান্ত স্নিগ্ধ হাওয়া, আম্রমুকুলের গন্ধ আর আমি... শুধু আমি। আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে শুধু আমি। আমি কারো কন্যা নই, কারো প্রেমিকা নই, কারো বন্ধু নই। আমি কারোর নই, কেউ আমার নয়। “এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে / সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে / গভীর ক্রন্দন -- 'যেতে নাহি দিব'।”

প্রকৃতি আমাকে যেতে দিতে চায় না। আমিও যেতে চাই না। নিঃশব্দে মিশে যেতে চাই এই নিবিড় বনচ্ছায়ায়। সমস্ত কোলাহল থেকে মন ছুটি চায়। সমস্ত সুখ, দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে মন বিশ্রাম নিতে চায়। প্রকৃতি বলে, ‘যেতে নাহি দিব।’ আমিও ফিসফিসিয়ে বলি, ‘যেতে নাহি চাই।’

কতক্ষণ চলে যায়? দিন? মাস?? বছর???

একটি বহুকালের চেনা, চিরপরিচিত হাত আমার হাত ধরে। তার আরেক হাতে আমার জুতোজোড়া। আমি তার হাত ধরে নিঃশব্দে উঠে আসি পথের ধুলোর পরে। সে পরম যত্নে আমার দুই পায়ে জুতো পরিয়ে দেয়। আমি আস্তে আস্তে মাথা নীচু করে, বুকের কাছে হাত জড়ো করে নিঃশব্দে এগোতে থাকি। দুজনের মুখেই কোন কথা নেই। যখন আমবাগান থেকে বেরিয়ে আসি, তখন সিন্ধুপারে চাঁদ উঠেছে...

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে