তবু আগুণ, বেণীমাধব, আগুণ জ্বলে কই!

 

মাথাটা আগুনের মতো জ্বলছে, কখনো কখনো, এই যেমন ন্যাড়াপোড়া হচ্ছিল, আমি দেখছিলাম আমার ভাইঝিকে টিউশান ব্যাচ থেকে আনতে গিয়ে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে। দেখছিলাম ছোট ছোট বাচ্চারা হইহই করে আনন্দ করছে বুড়ির বাড়ীর জ্বলন্ত অগ্নুচ্ছ্বাসকে কেন্দ্র করে। তাদের আনন্দ আমার ছোটবেলাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। দেখলাম এখনকার ছেলেমেয়েরা তার দিয়ে মালা বানায় না। আলু, বেগুন, কাঁচা টমেটো দিয়ে বানানো সেই মালা বুড়ির গলায় পরায় না। ন্যাড়া পোড়ানোর পর বাচ্চারা মোবাইল ফোন ঘাটতে ঘাটতে বাড়ীর পথ ধরে। তারা ওই আলুমাখা লেবু আর তেঁতুল দিয়ে মেখে একসাথে বসে খায় না। বসন্তের প্রথম শিশু উৎসব স্থানের অপ্রতুলতা, অসুস্থতার ভয় আর ফোনের হাতছানিতে আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে হয়তো হারিয়েই যাবে। একদম ফুরাবে না --- যতদিন গ্রামসমাজ আছে।

এই খুশির মধ্যে হঠাৎ করে অন্য এক বিষাদের সুর ভেসে এল। ঠিক বিষাদ নয়। রাগ। দিন দুয়েক ধরে ফেসবুক খুললেই যা ফেস করছি তার কারণে। আমার আগের প্রোফাইল বিশেষ কারণে বন্ধ করেছিলাম মাস দশেক আগে। আবার খুললাম নতুন করে নিজের আসল নাম আর ছবি দিয়ে। আগেরবার ছবিতে গোলাপ ফুল ছিল, আর নামের বদলে ছিল ছদ্মনাম। এবার স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করার দিন দুয়েকের মধ্যেই সুনামীয় ধাক্কা।

তেরো তারিখ প্রোফাইল খুলেছি। আর আজ এই মুহুর্ত পর্যন্ত আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট যা এসেছে তাতে করে সামনের সপ্তাহে আমায় আরেকটা প্রোফাইল খুলতে হবে মনে হচ্ছে। তাও ঠিক আছে, সামলে নিয়েছি। হঠাৎ করে গত দুই দিন ধরে ফেসবুকের বন্ধুরা ‘আমি কি করি’ আর ‘আমি কোথায় থাকি’ এই দুটি প্রশ্নে আমায় জেরবার করে দিচ্ছে। তারা আমার সাথে নির্মল বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু চায় না। আর চায় একটু গল্প করতে! ভাবো কান্ড! আমি আমার প্রোফাইলে ওই দুটি ব্যাপারে নিরুত্তর থাকার কারণে কৌতুহল এত বেশি যে আমার মনে হচ্ছে, দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো...। না বললে রাগ, অভিমান ইত্যাদি ইত্যাদি...

রাগ হল প্রচন্ড। মনে হল আমি যদি পুরুষ হতাম তাহলে কি এমন বন্ধুরা এগিয়ে আসত? না। আমার ভাই আমার বর্তমান বন্ধুসংখ্যা দেখে বেবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছে। আমি যদি কুৎসিত হতাম তাহলে? হয়ত অল্প আসত --- সহানুভূতিতে, দয়াবশত আর কিছুটা নারী হওয়ার পুরস্কারবশত। অনেকের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি এই দুদিনে। বেশ কয়েকজনকে ব্লক করেছি। তবুও উৎসাহের ঘাটতি নেই। মাত্র দুদিনে!

পাশাপাশি একটা ব্যাপারও আমায় অবাক করল। এদের সিংহভাগ মানুষ কিন্তু ত্রিশোর্ধ। অনেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে কদিনের মধ্যে, বা বিয়ে করেছে, কিম্বা অনেকে প্রৌড়ত্বের আঙ্গিনায়। এদের অধিকাংশ আমায় কোন কুপ্রস্তাব দেয় নি, অশ্লীল কথা তো দূর, ইঙ্গিতও করে নি। শুধু এবং শুধুমাত্র গল্প করতে চায়। তাতে সৌন্দর্যের পাশাপাশি যদি একটু ইন্টালেকচুয়াল যৌন আবেগ থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা! কিন্তু পাশাপাশি এও সত্য, যা আমাকে অবাক করল, বিস্মিত করল। তা হল, এত মানুষ একা! এত পুরুষ কথা বলতে চায় একটি অজানা মেয়ের সাথে! আসলে তারা গল্প করতে চায়, কারণ তারা একাকীত্বের সাথে লড়াই করে করে ক্লান্ত। তারা তাদের অবদমিত কামনার সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত। এত বিষাদ! এত হতাশা! এই হতাশার দিনে তাদের পাশের মানুষটির সাথে তারা কথা বলছে না, তারা তাদের বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে পারছে না। তারা কোন বই, গান বা সিনেমার মধ্যে আশ্রয় পাচ্ছে না। তারা এক নারীর কাছে এসে আশ্রয় চাইছে, স্নেহ চাইছে, দুটো মিস্টি কথা শুনতে চাইছে। কিম্বা আরোও বেশি কিছু, অন্য ক্ষুধা মেটাতে চাইছে! তাদের আশেপাশের পরিবেশ যা দিতে ব্যর্থ, তারা নিজেরাও তাদের আশেপাশের মানুষজনকে সেই পরিবেশ দিতে ব্যর্থ। শেষ দুদিন ধরে ক্রমাগত এই ব্যর্থ মানুষের ভীড়ে আমি হারিয়ে গেছি...

শুনেছি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরে আত্মহত্যা ২০% বেড়ে গেছে। বিষাদ, হতাশা গ্রাস করছে। তার থেকে বেরিয়ে আসার কি কোন পথ নেই??? জানি না।

 

ন্যাড়াপোড়া শেষে ছাইচাপা ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুনের কাছে আমার প্রশ্নটাকে সমর্পন করে বিস্ময় বিমুগ্ধ ভাইঝি, যে কি না প্রথম ন্যাড়াপোড়া দেখল, তার হাত ধরে আস্তে আস্তে বাড়ীর পথ ধরলাম।

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে